নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স হলো একধরনের গভীর মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা। এনডিই নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, এমনকি আমি নিজেও এই ব্যাপারে কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি যাদের নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে। যাদের এনডিই বা নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে তাদের ভাষ্য মতে, তারা মৃত্যুর খুব নিকট থেকে ফিরে এসেছে বা প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছে। নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স এখনো হাজারো রিসার্চের সাবজেক্ট, ফিলোসফিক্যালি এটা নিয়ে এখনো ডিবেট চলমান যে নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স আসলেও সম্ভব কি না বা এটা কোনো হ্যালুসিনেশন কি না। তবুও যাদের সাথে এটা ঘটেছে, তারা সবাই প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।
নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্সে কমন কিছু ঘটনা এরকম:
১. আউট অব বডি এক্সপেরিয়েন্স,
২. কোনো টানেলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া,
৩. মৃত কোনো আত্মীয়ের সাথে সাক্ষাৎ,
৪. কোনো একটা উজ্জ্বল ও উষ্ণ আলোর সংস্পর্শে যাওয়া,
৫. কয়েক মিনিটে পুরো জীবনের ফ্ল্যাশব্যাক পাওয়া
৬. তীব্র শান্তি ও ভালোবাসা অনুভব করা।
এরকম কিছু বিষয় আছে যেগুলো মানুষ এনডিই তে অভিজ্ঞতা করেছে এবং বিভিন্ন গবেষণায় তারা বিজ্ঞানীদের জানিয়েছেন। মজার বিষয় হলো, এই মানুষগুলো কোনো একটা নির্দিষ্ট এলাকার বা দেশের না। সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন কালচারের মানুষের থেকে পাওয়া এই অভিজ্ঞতার বর্ণনায় হুবহু মিল পাওয়া যায়।
নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে ফুল স্কেলে গবেষণা করা সবাই গত শতাব্দীতে মারা গেছেন। বর্তমান সময়ে এই টপিকে তেমন একটা গবেষণা দেখা যায় না। এনডিই নিয়ে সব থেকে বেশি কাজ করেছেন ডলোরেস ক্যানোন। উনার স্বামীর এক কার এক্সিডেন্ট হয়ে ক্লিনিক্যালি ডেড অবস্থা হওয়ার পরেও উনি উনার স্বামীকে হলিস্টিক ট্রিটমেন্ট করে সুস্থ করে তোলেন এবং উনি ও উনার স্বামী পরবর্তীতে এনডিই নিয়ে কাজ করেন কারণ উনার স্বামীর দাবি ছিল তাকে রিপার্পাসড করা হয়েছে।
নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স কয়েকটা উপায়ে হতে পারে। মানুষের জীবনে কিছু কিছু ঘটনায় মৃতপ্রায় অবস্থা হয়ে যায়। যেমন: জন্মগ্রহণ করার সময়, মৃত্যুর আগে, রোগাক্রান্ত হয়ে , দুর্ঘটনায় পড়ে, অক্সিজেন শূন্য অবস্থায় পৌঁছালে। এই অবস্থা গুলোতে মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্ল্যান্ড ডিএমটি নামক একধরনের শক্তিশালী হ্যালুসিনোজেনিক সাইকিডেলিক এজেন্ট রিলিজ করে। ডিএমটি সাধারণত অল্টারড পারসেপশন তৈরী করে। এই সব ক্রান্তিকালে ডিএমটির মাধ্যমে মানুষ যে নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স করে সেগুলোর মাধ্যমে কয়েকটা বিষয় ঘটে। হতে পারে, একজন মানুষ তার পুরো জীবনের ফ্ল্যাশব্যাক পায়। নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স করা অনেকে দাবি করেন তারা এই অবস্থায় বিশেষ কিছু এনটিটির দেখা পায়। এটা এমন এক অনুভূতি যেটা ভাষায় সুস্পষ্টভাবে লেখা যায় না।
এনডিই এক্সপেরিয়েন্স করা একজন বাংলাদেশীর সাথে আমি কথা বলেছি। উনার বক্তব্য ছিল এরকম: উনি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ এনডিই এক্সপেরিয়েন্স করেন। এমতাবস্থায় উনি এক অল্টারড পারসেপশনে চলে যান যেখানে একটা মজলিস বসেছে এবং সেখানে মজলিস পরিচালনা করা একজন এনটিটি, যাকে স্পষ্ট দেখা বা বোঝা যাচ্ছে না, উনাকে বলে যে তোমার সময় শেষ। কিন্তু উনি এটা মানতে রাজি না। পরে একটা বার্গেইনিং এক পর্যায়ে ঐ এনটিটি বলে যে ঠিক আছে তুমি ফিরে যাও। এখানে যার সাথে এনডিই টা ঘটেছে তিনি বলেন ঐ এনটিটি এবং উনার মাঝে চলা কমিউনিকেশন টা কোনো ভাষায় হয়নি কিন্তু উনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন।
রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃতপ্রায় একজনের এনডিই অনুযায়ী উনি একটা উষ্ণ সাদা রঙের আলোর উৎসের দিকে যাচ্ছিলেন। উনার বক্তব্য অনুযায়ী, যতই উনি এই আলোর উৎসের দিকে যাচ্ছিলেন, সারাজীবন যত ভালোবাসা অনুভব করেছেন তার থেকে বেশি ভালোবাসা অনুভব করছিলেন নিজের মধ্যে।
ইহজাগতিক ধর্ম বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে অনেকের এনডিই তে আসা এনটিটি গুলোর আকৃতি কেমন হবে। বেশ কয়েকজন দাবি করেছেন এঞ্জেল মাইকেল এসে কথা বলেছেন। এরকম অসংখ্য এনডিই এর বর্ণনা পাবেন গুগল বা ইউটিউবে।
মানুষের দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডিএমটি মজুদ থাকে যেকোনো সময়। কিন্তু সেটা চাইলেই ব্যবহার করা যায় না। আপনি চাইলেই নিজের সুবিধামত সময়ে এনডিই ঘটাতে পারবেননা। এর কারণ হলো মানুষের দেহে MAO( Mono-amine oxidase) একটা এনজাইম থাকে। এটা মানুষের দেহে থাকা ডিএমটিকে যখন তখন ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখে। কিন্তু কিছু কিছু গাছের পাতা ও শেকড়ে MAOi ( mono-amine oxidase inhibitor) থাকে যা এই ডিএমটি ওরালি এক্টিভ হতে সাহায্য করে এবং অনেক প্রাণীর এই অল্টারড পারসেপশনের উদাহরণ পাওয়া গেছে।
নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স একটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু সিনথেটিক ডিএমটি নেওয়ার মাধ্যমে এই এনডিই এর মতো অবস্থা তৈরি করা যায়। ড. রিক স্ট্রাসম্যান সিনথেটিক ডিএমটি এর উপর সর্বপ্রথম গবেষণা করেন। তার লেখা বই ডিএমটি দ্যা স্পিরিট মলিকিউল বইয়ে এই এক্সপেরিমেন্ট এর বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।
৬০ জন হিউম্যান সাবজেক্টের উপর সিনথেটিক ডিএমটি বিভিন্ন উপায়ে এডমিনিস্টার করা হয়। এই এক্সপেরিমেন্টটা কয়েকশত সেশন ব্যাপী চলমান ছিল। এই এক্সপেরিমেন্ট শেষে সবার থেকে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা হয়। মজার বিষয় হলো, এই ৬০ জনের থেকে নেওয়া অল্টারড পারসেপশন ট্রিপ এর বর্ণনা ন্যাচারালি ঘটা এনডিই এর বর্ণনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। টেস্ট সাবজেক্টদের বর্ণনা অনুযায়ী, তারা পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন স্পিরিচুয়াল ফিগার দেখেছেন, কেউ কেউ কোনো টানেলের মধ্যে দিয়ে কোনো একটা উষ্ণ আলোর দিকে উড়ে গেছেন।
এনডিইতে রিলিজিয়াস ফিগার দেখার ব্যাপারে আমি একটা রেডিট কমিউনিটিতে প্রশ্ন করেছিলাম যে, রিলিজিয়াস ফিগার দেখার উপরে ধর্মীয় বিশ্বাসের কোনো প্রভাব আছে কি না। একজন উত্তর দিয়েছিল এরকম: “আমি ডিএমটি জগতে ইসলামিক কারুকার্য করা কয়েকটা দেওয়াল দেখেছি কিন্তু আমি মুসলিম না”। আরেকজন বলছিলেন উনি উজ্জ্বল চোখের মেডুসা কে দেখেছেন। তবে এদের কেউ কেউ বলেছেন যে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এই ফিগার গুলো আসে এবং তাদের সাথে কথা বলে।
নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স বা ডিএমটি ট্রিপ থেকে মানুষের আমূল পরিবর্তন হয়েছে এরকম হাজারো উদাহরণ আছে। জীবনে সবরকম খারাপ কাজ করা অনেক মানুষের নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স এর পর তারা আর কখনো কোনো খারাপ কাজ করেনি কারণ এই নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স এর সময়ে তারা জীবনের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পেরেছেন। নেশাগ্রস্ত অনেক মানুষ তাদের জীবনে এনডিই বা ডিএমটি ট্রিপ হওয়ার পরে নেশা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনডিই এর উৎপত্তি এর ব্যাপারে একটা রিসার্চ পেপার লেখা হয়েছে। এখানে প্রাণী জগতের একটা বিশেষ ঘটনাকে মানুষের নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স এর উৎপত্তি হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফুড সাইকেলের প্রে জাতীয় প্রাণীরা প্রেডাটর কর্তৃক আক্রমণের সময় মৃত্যুর ভান করে। এক্ষেত্রে অনেক সময় প্রেডাটররা আক্রমণ না করে চলে যায় যেটাকে থ্যানাটোসিস বা টনিক ইমোবিলিটি বলে। কয়েকজন গবেষক এই থ্যানাটোসিস কে মানুষের নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স এর অরিজিন হিসাবে হাইপোথেসিস দাড় করিয়েছেন।
মানুষের নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স একটা ফ্যাসিনেটিং ঘটনা যেটাকে ফিলোসফিক্যালি, মেটাফিজিক্যালি, হিলিস্টিক্যালি ব্যাখ্যা করা গেলেও প্রচলিত বিজ্ঞান এটাকে শ্রেফ হ্যালুসিনেশন বলে। তবুও গত শতাব্দীতে উজ্জ্বল ভাবে জলে ওঠা এই টপিক নিয়ে এখনো আমার মতো অনেকেই গবেষণা করে চলেছেন।
সোর্স:
https://www.scientificamerican.com/article/what-near-death-experiences-reveal-about-the-brain/
https://academic.oup.com/braincomms/article/3/3/fcab132/6307709/
https://www.drugs.com/drug-class/monoamine-oxidase-inhibitors.html/
https://archive.org/details/RickStrassmanDMTTheSpiritMoleculex