একুশ শতকের প্রথম দশকে একদল গবেষক মানুষের নতুন এক প্রজাতির সন্ধান পায় যা ইতোমধ্যে পাওয়া ইতিহাসকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
২০০৮ সালের দিকে রাশিয়ার আলতাই পর্বতে ডেনিসোভা নামের এক গুহার মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলাকালে একজন যুবতীর একটা কেনি আঙ্গুলের হাড় পাওয়া যায়। এই হাড় টার ডিএনএ টেস্ট করে জানা যায় যে, যে মানুষটার হাতের আঙ্গুল এটা, সে পুরোপুরি আধুনিক মানুষও ছিল না, আবার মানুষের পূর্ববর্তী প্রজাতি নিয়ানডারথালও ছিল না। ডিএনএ টেস্ট শেষে এই সিদ্ধান্তে আসা হয় যে, ডেনিসোভা গুহার মধ্যে মানুষের একটা বসতি ছিল। কিন্তু তারা মানুষের অজানা একটা প্রজাতি। তখন এদের ডেনিসোভান নামকরণ করা হয়।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ডেনিস নামে একজন রাশিয়ান হারমিট একাকিত্বের খোঁজে আলতাই পর্বতের একটা নির্জন গুহায় থাকতে শুরু করেন। পরবর্তীতে যখন এই গুহার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় তখন ডেনিসের সম্মানে এই গুহার নামকরণ করা হয় ডেনিসোভা, এবং এখানে যে মানুষের ডিএনএ পাওয়া যায় তাদেরকে বলা হয় ডেনিসোভান হোমিনিন।
আধুনিক মানুষ, ডেনিসোভান আর নিয়ানডারথালদের মধ্যে ডিএনএগত ভাবে ০.৩% এর মতো পার্থক্য আছে। এটা খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, অতীতে কোনো একসময় আধুনিক মানুষ আর নিয়ানডারথালদের মধ্যে ইন্টার ব্রিডিং হয়েছিল। এতে করে যে নতুন প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে তারা দুই প্রজাতিরই ট্রেইট বহন করেছে।
ডেনিসোভান, আধুনিক মানুষ, আর নিয়ানডারথালদের মধ্যে বেশ কিছু দৃশ্যমান পার্থক্য আছে। বিশেষ করে ডেনিসোভানদের দাঁত আধুনিক মানুষ ও নিয়ানডারথাল দের দাঁতের থেকে আকারে বড় ও বেশি মজবুত। এ থেকে ধারণা করা হয়, তাদের খাদ্যাভ্যাস আধুনিক মানুষের থেকে আরো জটিল ছিল।
ডেনিসোভা গুহায় পাওয়া আঙ্গুলের হাড়ের রেডিও কার্বন এনালিসিস করে জানা যায় যে, ডেনিসোভান মানুষের গ্রুপ টা আজ থেকে প্রায় ৫০,০০০ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে দুনিয়ায় বেঁচে ছিল। বর্তমানে কোনো পরিপূর্ণ ডেনিসোভান মানুষ বেচে না থাকলেও বিশ্বের কয়েকটা দেশের মানুষ এখনো ডেনিসোভান ডিএনএ এর কিয়দংশ বহন করছে।
তিব্বতের মানুষের ডিএনএ এর মধ্যে ০.২-০.৪% ডেনিসোভান ডিএনএ আছে। তিব্বতের মানুষের ডিএনএ এর যে অংশটা তাদেরকে বিশ্বের অন্য মানুষের থেকে আলাদা করে রেখেছে সেটা হলো ইপিএএস১, এটাকে সুপার এথলেট জিন বলা হয়। মজার বিষয় হলো এই সুপার এথলেট জিন এর উৎপত্তি ডেনিসোভান মানুষের থেকে। এই সুপার এথলেট জিন এর কারণে তিব্বতের মানুষ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে হাজার মিটার উপরে থেকেও অক্সিজেনের অভাবে কোনো সমস্যায় পড়ে না।
পলিনেশিয়ার কয়েকটা দ্বীপের মানুষের মধ্যে ডেনিসোভান ডিএনএ এর কিয়দংশ পাওয়া গেছে। আরো পাওয়া গেছে অস্ট্রেলিয়ার এবরিজিনাল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে, যারা সাধারণত খুব দুর্গম এলাকায় টিকে থাকার জন্য এডাপ্ট করে নিয়েছে।
আফ্রিকা সহ আরো বেশ কয়েকটা এলাকার মানুষের ডিএনএতে ডেনিসোভান ডিএনএ এর সন্ধান পাওয়া গেছে। খেয়াল করলে দেখবেন, রাশিয়ার আলতাই পর্বত থেকে আফ্রিকা, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এসব এলাকা হাজার হাজার মাইল দূরে। তবুও সেখানে এদের ডিএনএ এর অস্তিত্ব পাওয়া অন্তত একটা বিষয় প্রমাণ করে যে ডেনিসোভান মানুষ পৃথিবীতে এসব জায়গা গুলো ঘুরে বেড়িয়েছে এসব এসব জায়গায় এসে এসব এলাকার মানুষের সাথে ইন্টার ব্রিডিং করেছে।
এছাড়াও ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ার কয়েকটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেনিসোভান ডিএনএ এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ডেনিসোভানরা দক্ষিন এশিয়ার নতুন আধুনিক মানুষের সাথেও ইন্টারব্রিড করেছিল।
ডেনিসোভা গুহায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে তার মধ্যে পাথরের সরল কিছু টুলস পাওয়া গেছে। তবে এর মধ্যে সবথেকে ইন্টারেস্টিং যে বস্তুটা পাওয়া গেছে তা হলো একটা ব্রেসলেট। এটা ডেনিসোভান ব্রেসলেট নামে পরিচিত। এই ব্রেসলেট টা ক্লোরাইট নামের একটা ডার্ক গ্রীন পাথরের তৈরি। মজার বিষয় হলো, এই ক্লোরাইট পাথর ডেনিসোভা গুহার আশেপাশে কোথাও পাওয়া যায় না। অন্তত দুইশত মাইল দূরে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ডেনিসোভানরা হয়তো কোনো লেনদেনের মাধ্যমে ঐ পাথর তাদের গুহার মধ্যে এনে ব্রেসলেট টা বানিয়েছে। এই ব্রেসলেটে খুব নিখুঁত একটা ড্রিল করা আছে এবং খুব সুক্ষ্ম ভাবে পলিশ করা।
পুরো আর্কিওলজি জগত এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। কারণ ব্রেসলেটের যে বর্ণনা টা দিলাম সেটা আজ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে যান্ত্রিকভাবে সম্ভব ছিল এটা কনভেনশনাল আর্কিওলজি স্বীকার করে না।
ডেনিসোভান এই ব্রেসলেটটা আফ্রিকা ও ইউরোপে খুঁড়ে পাওয়া সবথেকে পুরনো অলংকার গুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু মজার বিষয় হলো, ডেনিসোভান ব্রেসলেটের ক্রাফ্টসম্যানশীপ সমসাময়িক অন্য সব কিছুর থেকে বেশ কয়েকগুণ উন্নত ছিল।
ডেনিসোভা গুহার মতো নব্য আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন যা গবেষণার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে যে ইতিহাসের খুব অল্প কিছু আমরা জানি, তাই কনক্লুসিভ সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে ভাবতে হবে, মানুষ এই পৃথিবীতে প্রায় চার লাখ বছরের বেশি সময় ধরে চারন করেছে। তাদের ইতিহাসের নতুন কোনো অধ্যায় উন্মুক্ত হলে সেটা বিবেচনায় নিয়ে নতুন করে পড়তে হবে ইতিহাস।